টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলায় উপস্থিত। হাওরটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত । টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ১০০ বর্গ কিমি এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এছাড়া ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলরব এ মুখরিত এই হাওর ।
মাছের লালন-পালন, সংরক্ষন এবং আহরনের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর প্রসিদ্ধ। জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি আর পানির মাঝে ডুবে আছে অসংখ্য বাড়িঘর। বর্ষাকালে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াতের জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয় । টাঙ্গুয়ার হাওর প্রকৃতির অনন্য দানে সমৃদ্ধ।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যেভাবে যাবেন
ঢাকা to সুনামগঞ্জঃ আপনি প্রথমে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাবেন। ঢাকার মহাখালী অথবা সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠবেন। এসব বাস স্ট্যান্ড থেকে এনা, শ্যামলী, মামুন পরিবহনের বাস ছাড়ে। জন প্রতি ভাড়া ৫৫০ থেকে ৮৫০ টাকা ( এসি অথিবা নন এসি ) । ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগে।
সিলেট to সুনামগঞ্জঃ সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য সিলেটের কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল বা সিটিং বাসে করে আপনি যেতে পারেন। সিটিং বাসের ভাড়া ১০০ টাকা করে জন প্রতি। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা লাগে। আপনি চাইলে সিলেট শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লাইট গাড়িতে ২০০ টাকা দিয়ে যেতে পারেন।
সুনামগঞ্জ to টাঙ্গুয়াঃ সুনামগঞ্জে পৌঁছানোর পর সুরমা ব্রিজের উপর লেগুনা, সিএনজি, বাইক দেখতে পাবেন। লেগুনা বা সিএনজি করে তাহিরপুর যাবেন তারপর সেখান থেকে নৌকায় করে ঘুরে আসতে পারবেন টাঙ্গুয়ার হাওরে। সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ছোট বা বড় সাইজের নৌকা ভাড়া করতে পারবেন।
হাওরে নৌকা ও হাউজবোট ভাড়া
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণ করার একমাত্র পরিবহন হচ্ছে নৌকা বা হাউজবোট। আপনি আপনার সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী বোট বা নৌকা ভাড়া নিতে পারবেন। হাওরে ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের নৌকা রয়েছে। নৌকার পাশাপাশি রয়েছে নানা রকমের হাউজবোট।
নৌকার ভাড়া
মাঝারি সাইজের নৌকা ভাড়া ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা। এই সাইজের নৌকাগুলোতে ১৫-২০ জন বসতে পারে আর ৭/৮ জন এর ঘুমানোর মত জায়গা রয়েছে। ওয়াশরুমের ব্যাবস্থাও রয়েছে এইসব নৌকায়। বড় সাইজের নৌকাগুলোর ভাড়া ৭০০০ থেকে ১০০০০ টাকার মতন। এসব নৌকায় ৩০ থেকে ৩৫ জন মানুষ বসতে পারে আর রাতে ১০/১২ জনের ঘুমানোর জায়গা রয়েছে। নৌকা ভাড়া করার সময় নৌকার কন্ডিশন কেমন তা ভালোমত দেখে নিবেন। অনেক সময় মাঝিরা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ নিয়ে থাকে যার কারনে নৌকা ডুবে যাওয়ার বা অন্য দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
হাউজবোট ভাড়া
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজের হাউজবোট রয়েছে। প্যাকেজ অনুযায়ী ভাড়া কম-বেশি হবে। আপনি যদি একটি হাউজবোট ফুল রিজার্ভ করেন তাহলে ভাড়া পড়বে ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা। হাউজবোট এর মান, ধারণ ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী ভাড়া কম-বেশি হতে পারে। একদিনের থাকা-খাওয়া, টাঙ্গুয়ার হাওরের আশেপাশের স্পটগুলো ঘুরার জন্য প্রিমিয়ার বোটগুলোতে জন প্রতি ৬০০০ থেকে ১০০০০ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। তারপর সেমি হাউজবোট গুলোতে জন প্রতি ৪৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা লাগে। হাউজবোট বুকিং করার আগে তারা কি কি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তা জেনে নিবেন। আপনি যদি শুধু দিনের জন্য বোট ভাড়া করেন তাহলে খরচ কিছুটা কম পড়বে।
রাতে কোথায় থাকবেন
পর্জটনকারীরা সাধারণত রাত্রি যাপনের জন্য বোটেই অবস্থান করেন। তবে আপনি চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওরের মাঝে হাওর বিলাস নামে একটি কটেজ রয়েছে সেখানেও থাকতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে সুনামগঞ্জে ফেরত এসে সেখানকার কোন একটি হোটেলে রুম ভাড়া নিতে পারেন। তবে একটি রোমাঞ্ছকর অভিজ্ঞতার জন্য আপনি হাউজবোটে রাতে থাকতে পারেন।
হাওরে যেয়ে কোথায় খাবেন
সাধারনত হাউজবোট গুলোতে খাবারের ব্যবস্থা করাই থাকে। আপনি যদি চান নিজেরা রান্না করেও খেতে পারেন সেক্ষেত্রে নিজেরা আগে থেকে বাজার করে নিয়ে যাবেন। তাহিরপুরে খাবার হোটেল আছে সেখানে গিয়েও খেতে পারেন। খাবার মেনুতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ ধরনের মাছের আইটেম থাকে, হরেক রকমের ভর্তা, ভাজি, হাঁস-মুরগির মাংস ইত্যাদি দিয়ে খুব তৃপ্তি করে খেতে পারবেন।
হাওরে ভ্রমণ খরচ
টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য জন প্রতি মিনিমান ৮-৯ হাজার টাকা বাজেট রাখতে হবে। প্রথমে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জে বাসে যাওয়া আসা মিলে প্রত্যেকের ১১০০-১৫০০ টাকা লাগবে। তারপর সুনামগঞ্জ থেকে সিএনজি বা লেগুনা করে আসতে ২০০-৪০০ টাকা লাগবে। এরপর নৌকা বা বোটে জন প্রতি সর্বনিম্ন ৫০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০০০০ টাকা লাগতে পারে। এছাড়া খাওয়া-দাওয়া খরচও রয়েছে।
ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা
যেকোন জায়গায় ভ্রমণে গেলে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে আপনাকে যেই সতর্কতাগুলো অবলম্বন করতে হবে তা হলোঃ
- হাওরে যেহেতু বেশিরভাগ সময় আপনাকে পানিপথে ঘুরতে হবে তাই সাথে একটি লাইফ জ্যাকেট রাখবেন।
- কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে যাবেন তাহলে কম খরচে ঘুরতে পারবেন আবার নিরাপত্তা নিয়েও খুব একটা ভয়ে থাকতে হবে না।
- হাওরে ভারী বজ্রপাত এবং বৃষ্টি নামলে নৌকার ভিতরে অবস্থান নিন।
- যেকোন ধরনের ময়লা আবর্জনা, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, প্যাকেট ইত্যাদি পানিতে ফেলবেন না।
- অতিরিক্ত সাউন্ড দিয়ে বা উচ্চস্বরে গান বাজাবেন না। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
- হাওরে গিয়ে পাখি বা বন্য প্রানী, মাছ এসব শিকার করবেন না বা এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন কোন কাজ করবেন না।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাসে হাওর পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। এ সময়টাতে নৌকা ভ্রমণে বেশি মজা পাওয়া যায়। তাই আষার-শ্রাবণ মাসকে বা বর্ষাকালকে হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় ধরা হয়। আপনি জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যেকোন সময়েই টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যেতে পারেন এবং প্রকৃতির অপার স্নিগ্ধতা অনুভব করতে পারেন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণী ও জীববৈচিত্র
টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছগাছালি, পশুপাখি, মাছ ইত্যাদি। হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হলো হিজল-করচ। এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। হিজল গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিটার লম্বা হয়। হিজল গাছ পাখিদের জন্যও নিরাপদ আশ্রয়স্থল। হিজল করচের দৃষ্ট নন্দন সারি টাঙ্গুয়ার হাওরকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর রূপ দান করেছে। এছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দুইশ প্রজাতির গাছ রয়েছে এই হাওরে। বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি। বিলুপ্ত প্রায় পাখিদের মধ্যে রয়েছে বিরল প্রজাতির ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক । স্থানীয় প্রজাতির ভিতরে রয়েছে শকুন, পানকৌড়ি, ডাহুক, গাঙচিল, বক, কাক, সারস, শঙ্খচিল ইত্যাদি। তাছাড়া শীতকালে দেশি-বিদেশি নানা জাতের নানা ধরনের পাখির আগমন ঘটে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় দুইশ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মধ্যে রুই, বোয়াল, কাতল ও কার্প জাতীয় মাছ রয়েছে। হাওরের মিঠা পানির মাছ সারা দেশের মানুষের কাছে প্রিয় এবং হাওরের মাছের চাহিদাও অনেক বেশি। টাঙ্গুয়ার হাওরে আরও রয়েছে নানা ধরনের জলজ প্রানী, সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ, গিরগিটিসহ নানা ধরনের প্রাণী।
টাঙ্গুয়ার হাওরের দর্শনীয় স্থান
দর্শনীয় স্থান বলতে টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে কিছু সোয়াম্প ফরেস্ট, রয়েছে নিলাদ্রি লেক ( শহীদ সিরাজ লেক ), শিমুল বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, যাদুকাটা নদী, বারিক্কা টিলা, লাকমাছড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে জোছনা রাতে পুর্নিমার চাঁদের আলো আর দমকা বাতাস মানবমনকে শান্ত করে। অতিথি পাখি দেখতে আপনি শীতকালে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে পারেন। শীতের সময় নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখির বিচরণ ঘটে এখানে।