হাকালুকি হাওর কোন জেলায় অবস্থিত
হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর মিঠাপানির জলাভূমি। সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫ টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত মিঠা পানির এই জলাভূমি।
হাওরটি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০%), কুলাউড়া (৩০%), এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে (১৫%), গোলাপগঞ্জ (১০%) এবং বিয়ানীবাজার (৫%) জুড়ে বিস্তৃত। এই হাওরের আয়তন প্রায় ১৮,১১৫ হেক্টর,তন্মধ্যে শুধুমাত্র বিলের আয়তনই ৪,৪০০ হেক্টর। ভৌগলিকভাবে এর অবস্থান, উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় এবং পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশে।
হাকালুকি হাওর কিভাবে যাবেন
মৌলভীবাজার সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হাওর। ঢাকা থেকে হাকালুকি হাওরে যেতে প্রথমে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া যেতে হবে। সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী থেকে বাসে করে প্রথমে কুলাউড়া বা বড়লেখায় পৌঁছে সেখান থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাকালুকিতে। বাস এর মধ্যে শ্যামলী, রূপসী বাংলা, হানিফ, সোহাগ উল্লেখযোগ্য। বাসের ভাড়া ( এসি অথবা নন এসি) জন প্রতি ৩৫০ থেকে ৯০০ টাকা। এছাড়াও আরো একাধিক বাস রয়েছে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় যাত্রী আনা-নেয়া করে। ভোর থেকে শুরু করে রাত ১টা পর্যন্ত এসব বাস পাবেন। বাসে যেতে সময় লাগবে ৪ থেকে ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট।
ট্রেনে করে আসতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে চলে আসতে হবে কুলাউড়া রেল স্টেশনে। ট্রেনের ভাড়া প্রকার ভেদে ১২০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা। সেখান থেকে অটোতে করে চলে যেতে পারেন হাওরে। তবে হাকালুকি যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ঢাকা থেকে উপবন এক্সপ্রেসে উঠে নামতে হবে মাইজগাঁও স্টেশনে। এটি সিলেটের ঠিক আগের স্টেশন।
হাকালুকি হাওর ভ্রমণ
বর্ষা এবং শীত উভয় ঋতুই হাকালুকি হাওর ভ্রমনের জন্য উপযোগী সময়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপূর্ব লীলাভূমি হাওরটি বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে সৃষ্টি করে অপরূপ ও নয়নাভিরাম দৃশ্যের।
বর্ষাকালে এই হাওরটি একটি অথৈ সাগরে পরিণত হয়। সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ, চারদিকে পানি আর পানি। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে অনেকটা কূলহীন। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে একেকটা ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছ আর পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন সৌন্দর্যের ঝাঁপি মেলে বসে। পানিতে ভেসে উঠে শাপলা শালুক।
শীতকালে অতিথি পাখিরা সারি বেঁধে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসতে থাকে বিলগুলোতে।।এছাড়া শীতকালে মৎস্য আহরণ এবং অতিথি পাখিদের আগমন পর্যটকদের হাওর ভ্রমনকে সার্থক করে তোলে। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্যের যে প্রতিচ্ছবি তৈরি হয় তা বেশ মনোমুগ্ধকর। এ বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো দুটো প্রধান নদী জুড়ি ও ফানাই। তবে বর্ষাকালের ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে হাওর সংলগ্ন সমগ্র এলাকা প্লাবিত হয়ে সাগরের রূপ ধারণ করে।
আরও দেখুন
হাওরের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য
হাকালুকি হাওরের স্থায়ী জলাশয়গুলোতে নানা ধরনের উদ্ভিদ জন্মে। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়। হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি রয়েছে, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি।
এখানে প্রতি বছর শীতকালে বিরল প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম ঘটে। অতিথি পাখির মধ্যে বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, গুটি ইগল, কাস্তেচড়া, কুড়া ঈগল, সরালি, পানভুলানি, কালিম, টিটি, পেডি উল্লেখযোগ্য। দেশীয় প্রজাতির নানা পাখির মধ্যে রয়েছে- ছাড়া সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজ ইত্যাদি।প্রতি বছর শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে উঠে গোটা এলাকা।
এছাড়া ১০৭ প্রজাতির মাছ রয়েছে, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। হাওরের স্বাদু ও মিঠাপানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে, আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। যেগুলোর অনেকাংশে এখন বিলুপ্তির পথে।
হাকালুকি হাওরের ২৩৮ টি বিল
প্রায় সারাবছরই বিলগুলো পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। বর্ষাকালে এই হাওরটি একটি অথৈ সাগরে পরিণত হয়। এর বিস্তৃত জলরাশি দেখে মনে হয়, এ যেন এক মহাসাগর।
হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলসমূহ হলো- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলারকোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালাবিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল।
হাকালুকি হাওর ভ্রমনের উপযুক্ত সময়
বর্ষা এবং শীত উভয় ঋতুই হাকালুকি হাওর ভ্রমনের জন্য উপযোগী। তবে অতিথি পাখি দেখার জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস হাওর ভ্রমনের আদর্শ সময়। এই সময় হাওরের চারপাশ অতিথি পাখির কোলাহলে মুখর হয়ে থাকে। অন্যদিকে বর্ষাকালে হাওরে বন্যার পানি সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। তাই বর্ষাকালে হাওরের অপরূপ প্রকৃতি উপভোগ করতে চাইলে জুন-আগস্ট মাসই উপযুক্ত সময়।
হাকালুকি হাওর সংরক্ষণ
হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা বিবেচনা করা হয়। এটি জলাভূমির সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য রামসার এলাকা হিসেবে এটি সংরক্ষিত আছে।
হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য উপভগের জন্য প্রতিবছর ছুটে আসেন হাজারো ভ্রমণ প্রেমিক মানুষজন। তাই হাকালুকি হাওরের ফেঞ্চুগঞ্জ অংশকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষে গ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প।
হাওরে দিন দিন পাখির সংখাও কমে যাচ্ছে । বিলে পানি কমে যাওয়ার কারনে এরূপ হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়াও দুর্বৃত্তরা হাওরে বিষটোপ দিয়ে পাখি নিধন করেছে। তাই দ্রুত পাখি শিকার বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।